কিভাবে একটি স্টক বা শেয়ারের ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করবেন?

একটি কোম্পানীর ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করার জন্য কিছু বেসিক পদক্ষেপ রয়েছে। এখানে আমরা সংক্ষেপে তা আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

কোম্পানীর আর্থিক বিবরনী বা Financial Statement:

কোন শেয়ার কেনার আগে ঐ কোম্পানীর আর্থিক অবস্থা জানার জন্য কোম্পানীর আর্থিক বিবরনী বা Financial Statement বোঝা আবশ্যক। কোম্পানী আইন, ১৯৯৪ এর ১৮৫ ধারা মোতাবেক কোম্পানীগুলো তাদের ব্যালেন্স শীট, লাভ-ক্ষতির হিসাব প্রস্তুত করে থাকে। আর্থিক বিবরনীতে প্রকাশিত নিন্মোক্ত ৩টি বিষয় বিশ্লেষন করা প্রয়োজন।

১. ব্যালেন্স শীট (Balance Sheet)

২. লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবরনী (Income Statement / Profit & Loss Account)

৩. নগদ তহবিল প্রবাহ (Cash Flow Statement

ব্যালেন্স শীটঃ

কোম্পানীর বার্ষিক (Yearly) বা অর্ধবার্ষিক (Half Yearly) বিবরণীতে এই ব্যালেন্স শীট দেয়া থাকে। এখানে কোম্পানীর সম্পদ ও দায়-দেনার বিবরণ থাকে। ব্যালেন্স শীটে ব্যবহৃত কিছু শব্দের ব্যাখ্যা নিন্মরুপ-

১। কোম্পানীর মূলধন (Share Capital):

কোম্পানীর মূলধন কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত থাকতে পারে।

ক) অনুমোদিত (Authorised) / নিবন্ধিত (Registered) / নোমিনাল (Nominal) মূল্ধনঃ

যে পরিমাণ মূলধন সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে কোম্পানি নিবন্ধিত হয় তাকে অনুমোদিত / নিবন্ধিত / নোমিনাল মূল্ধন বলে। এর চেয়ে বেশি মূলধন শেয়ার বিক্রয় করে সংগ্রহ করা যায় না।

খ) ইস্যুকৃত মূলধন (Issued Capital):

অনুমোদিত মূলধনের যে অংশ জনগণের নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উপস্থাপিত করা হয় তাকে প্রচারিত মূলধন বা ইস্যুকৃত মুলধন বলা হয়। ইস্যুকৃত মুলধন অনুমোদিত মূলধনের সমান বা কম হয়ে থাকে। তবে কোন অবস্থাতেই বেশী হতে পারবে না।

গ) বিলিকৃত মূল্ধন (Subscribed Capital):

ইস্যুকৃত মূলধনের যে অংশ বিনিয়োগকারীগণ আবেদন পত্রের মাধ্যমে ক্রয় করতে স্বীকার করেছে এবং যে পরিমাণ শেয়ার বণ্টিত হয়েছে তাকে বিলিকৃত মূলধন বলে। বিলিকৃত মূলধন সাধারনত ইস্যুকৃত মূলধনের সমান হয়ে থাকে। তবে কমও হতে পারে।

ঘ) তলবকৃত মূলধন (Called-up Capital):

বিলিকৃত মূলধনের যে অংশ আদায় করার জন্য আবেদনকারীর নিকট আহ্বান করা হয় তাকে তলবী বা তলবকৃত মূলধন বলা হয়। শেয়ার মূল্যের সম্পূর্ণ অংশ একসঙ্গে বা বিভিন্ন কিস্তিতে আদায় করার জন্য আহ্বান করা যেতে পারে। শেয়ারের পূর্ণ মূল্য প্রদানের জন্য আহ্বান করা হলে বিলিকৃত মূলধন এবং তলবী মূলধন সমান হবে।

ঙ) আদায়কৃত মূলধন (Paid-up Capital):

তলবকৃত মূলধনের যে অংশ শেয়ার মালিকদের নিকট হতে নগদ পাওয়া যায় তাকে আদায়কৃত মূলধন বলে। তলবী মূলধন থেকে বকেয়া তলব বাদ দিলে আদায়কৃত মূলধন পাওয়া যাবে।

চ) মোট পরিশোধিত মূলধন (Total Paid-up Capital):

এটি হল কোন নির্দিষ্ট দিনে কোম্পানীর মোট ইস্যুকৃত শেয়ার এবং তার নিজ শেয়ারের অভিহিত মূল্যের গুনফলের সমষ্টি।

ছ) মোট বাজার মূল্ধন (Total Market Capitalization):

কোন নির্দিষ্ট দিনে কোম্পানীর সর্বমোট ইস্যুকৃত শেয়ার এবং উক্ত নির্দিষ্ট দিনে ঐ কোম্পানীর শেয়ার প্রতি বাজার মূল্যের গুনফলের সমষ্টি হল মোট বাজার মূলধন।

২। সঞ্চিতি ও উদ্বৄত্ত (Reserves and Surplus): কোন কোম্পানী যদি মুনাফা করে তার সবটা শেয়ারহোল্ডারদের নিকট বন্টন না করে তবে সেটাই সঞ্চিতি ও উদ্বৃত্ত। এগুলো শেয়ার প্রিমিয়াম, আয়কর সঞ্চিতি, লভ্যাংশ সমীকরন তহবিল, অবন্টিত মুনাফা হিসেবে ব্যালেন্স শীটে দেখানো হয়।

৩। স্থায়ী সম্পদ (Fixed Assets): কোম্পানীর স্থাবর সম্পত্তি, অফিস, গাড়ী, যন্ত্রপাতি, সুনাম ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।

৪। তড়িৎ সম্পত্তি (Quick Assets): যে সমস্ত সম্পত্তি অতি দ্রুত নগদ অর্থে রুপান্তরিত করা যায় সেগুলোই তড়িৎ সম্পত্তি।

৫। নীট সম্পত্তি (Net Worth): মোট সম্পত্তি থেকে বহির্দায় সমূহ বাদ দিয়ে নীট সম্পত্তি বের করা হয়। আবার পরিশোধিত মূলধনের সাথে সঞ্চিতি ও উদ্বৃত্ত যোগ করেও এটি পাওয়া যায়।

৬। চলতি মূলধন (Working Capital): চলতি সম্পত্তি ও চলতি দায়ের পার্থক্য হলো চলতি মূলধন।

ব্যালেন্স শীটে সম্পদকে নগদায়নের সুবিধার ভিত্তিতে লেখা হয়। প্রথমে নগদ অর্থ তারপর স্থায়ী সম্পদ ও অপরিমাপযোগ্য সম্পদ লেখা হয়। ব্যালেন্স শীটে সম্পদের পর তার দায়-দেনার হিসাব দেয়া থাকে।

ব্যালেন্স শীটের যে সব বিষয় বিশ্লেষন করবেন-

▶️ লাভ-ক্ষতির পরিমাণ,

▶️ লাভ-ক্ষতির হ্রাস-বৃদ্ধির ধারা,

▶️ পন্যের উৎপাদনের পরিমাণ, দরের হ্রাস বৃদ্ধি,

▶️ ব্যবসা পরিচালনার ব্যায়ের হ্রাস বৃদ্ধি,

▶️ লভ্যাংশ প্রদানের ধারা এবং এই ক্ষমতার হ্রাস বৃদ্ধি,

▶️ কাঁচামালের / অন্যান্য উপকরনের মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধি,

▶️ চলতি সম্পদ থেকে চলতি দায় মেটানোর ক্ষমতা,

▶️ ঋণের পরিমাণ এবং সুদের তারতম্যের হিসাব,

▶️ অ-পরিচালন আয়, তথা বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুদ ও লভ্যাংশ, ব্যাংক আমানত থেকে প্রাপ্ত সুদ, পুরাতন যন্ত্রপাতি বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ইত্যাদি,

▶️ সঞ্চিতি ও উদবৃত্তি-এর পরিমাণ।

অর্থের উৎস বা Source Of Fund:

কোম্পানীর অর্থ কেবল কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডারগণ যোগান দেন না। ব্যাংক থেকে ঋনও নিতে হয়। এই ঋণ আবার দীর্ঘ মেয়াদী বা স্বল্প মেয়াদী, নিশ্চিত ঋণ (যা কোম্পানীর কোন সম্পদের উপর চার্জ সৃষ্টি করে), এবং অনিশ্চিত ঋণ অথবা উভয় প্রকারের হতে পারে।

লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবরনী বা Income Statement / Profit & Loss Account:

কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এ লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবরনী তৈরীর কোন নির্দিষ্ট ছক প্রদান করা হয়নি, তবুও কোম্পানীগুলো যে ছকে লাভ-ক্ষতির স্টেটমেন্ট প্রদান করে তা থেকে আপনাকে সব কিছু বুঝে নিতে হবে। এই বিবরনী থেকে মূলত কোম্পানীর লাভ-ক্ষতি এবং ইপিএস জানা যায়।

এখানে সাধারণত যে বিষয়গুলো থাকে তা হলো- ব্যাবহৃত কাঁচা মালের হিসাব, উৎপাদন খরচ , বিক্রয় সংক্রান্ত ব্যয়, নীট বিক্রয়লব্ধ অর্থ, পরিচালন ব্যয়, মোট মুনাফা, পরিচালন মুনাফা, নীট আর্থিক আয়, কর, কর পূর্ব মুনাফা, কর পরবর্তী মুনাফা, চলতি কর, বিলম্বিত কর, শেয়ার প্রতি আয় ইত্যাদি।

নগদ তহবিল প্রবাহ বা Cash Flow Statement:

কোম্পানীতে বিভিন্ন উৎস থেকে নির্দিষ্ট সময়ে অর্থের আগমন ও তার ব্যবহার এর মাধ্যমে তহবিলের হ্রাস বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিবরনী হল নগদ তহবিল প্রবাহ প্রতিবেদন বা cash Flow Statement। এই বিবরনী প্রস্তুত করারও কোন নির্দিষ্ট ছক নেই। বিভিন্ন কোম্পানী এটি বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করে থাকে। এই বিবরনীতে তহবিলের দুটু উৎস দেখানী হয়, যথা-

১/ পরিচালন থেকে নগদ প্রাপ্ত তহবিল

২/ অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত নগদ তহবিল

এই তহবিল প্রবাহ বিশ্লেষনের মাধ্যমে কোম্পানীর ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা, আর্থিক স্বচ্ছলতা এবংমুনাফা অর্জনের ক্ষমতা যাচাই করা যায়।