শেয়ার বাজারে যারা নিয়মিত তারা “ডে-ট্রেডিং” কথাটির সাথে সবাইবেশ পরিচিত। যারা শুনেছেন কিন্তু জানেন না তাদের জন্যই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
আধুনিক যুগে ইন্টারনেটের ব্যপক প্রসারের জন্য শেয়ার বাজারে কেনা বেচা বা ট্রেডিং এখন আর শুধুমাত্র বড় বড় ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউট এবং ব্রোকারেজের কাছেই নেই। যে কোন ব্যক্তি তার হাতেথাকা ছোট মুঠোফোনের মাধ্যমে খুবই অল্প সময়ে স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে যে কোন ট্রেডিংডে তেই বিশাল এই মার্কেটে শেয়ার ট্রেড করার সুযোগ লাভ করতে পারেন।
শেয়ারবাজারে ডে-ট্রেডিং বলতে মূলত দৈনন্দিন ভিত্তিতে শেয়ার ক্রয় ও বিক্রয়ের রীতিকে বোঝায়।এটি এমন একটি ট্রেডিং কৌশল যেখানে একই দিনে শেয়ারে প্রবেশ ও প্রস্থান করা হয়। যেহেতুএকই দিনের মধ্যে ট্রেডিং হয়, তাই এই কৌশলটি কে ইন্ট্রাডে (Intraday) ট্রেডিং হিসেবেও উল্লেখ করা যায়। যারা ডে ট্রেড করে তাদেরকে “ডে ট্রেডার” বলা হয়।
ধরা যাক শেয়ার বাজারে আপনার পুঁজি ১ লাখ টাকা। রবিবার আপনি ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনলেন। সোমবার বাকি ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনলেন। এখন রবিবারে কেনাশেয়ার মঙল বারে বিক্রি করে অন্য আরেকটি শেয়ার এবং সোমবারে কেনা শেয়ার বুধবারে বিক্রিকরে বুধবারেই আবার আরেকটি শেয়ার বা ঐ একই শেয়ার পুনরায় কিনলেন।
এভাবে মঙলবারে কেনা শেয়ার বৃহস্পতিবারে এবং বুধবারে কেনা শেয়ার পরবর্তী রবিবারে বিক্রি করে আবার পুনরায় কিনলেন। এই জাতীয় লেনদেনকেই ডে-ট্রেডিংবলে।
ডে-ট্রেডিং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে শেয়ার ব্যবসা থেকে যথাসম্ভব মুনাফা অর্জন করা। অর্থাৎ প্রতিটি ট্রেড থেকে অল্প অল্প মুনাফা অর্জন করে পোর্টপোলিও-র সমৃদ্ধি ঘটানো। অর্থাৎ নিয়মিত শেয়ার বাজারে ট্রেড করে দৈনন্দিন কিছু উপার্জন করা।
বিনিয়োগ কারীদের মধ্যে যারা টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস বা প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ বোঝেন, তাঁরা স্মার্ট ডে-ট্রেডিং করে প্রতিদিন কিছু কিছু মুনাফার পাশাপাশি নিজের পোর্টপোলিও কে বড় পতন থেকে রক্ষা করতে পারেন।
কিন্তু বাজার এবং সংশ্লিষ্ট স্টক বা পণ্যের আচরণ সম্পর্কে যাঁদের তেমন ধারনা নেই, তাঁরা ডে-ট্রেডিং করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। তাই ভালভাবে বাজার-বিশ্লেষণ শিখে নিয়ে শুরু করা যেতে পারে ডে-ট্রেডিং।
ইন্ট্রাডে-ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে রিটার্নের কথা বলা হয়। তবে এই উচ্চ রিটার্নের পাশাপাশি উচ্চ হারে ঝুঁকিও রয়েছে। এক্ষেত্রে ট্রেডিং চলাকালীন সময়ে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে মার্কেটের পিছনে লেগে থাকতে হবে, না হলে বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। এর পাশাপাশি কোম্পানির প্রতিটি বিষয়, প্রযুক্তিগত দিক, ডেইলি চার্ট-সহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপরও নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
ডে ট্রেডারগনতাদের ট্রেডিং সেশনে বেশ কিছু স্ট্র্যাটেজির ব্যবহার করেন, যেমন-
❇️ স্ক্যাল্পিং (Scalping)- এইস্ট্যাটেজির মূল বৈশিষ্ট হল ছোট ছোট করে বেশ কয়েক বার ট্রেড করা। এই স্ট্যাটেজিতে একজন ডে ট্রেডার খুবই ছোট প্রফিট টার্গেট নিয়ে একই শেয়ার একাধিকবার ট্রেড করে থাকেন।
❇️ রেঞ্জ ট্রেডিং (Range Trading)- এইস্ট্র্যাটেজিতে প্রাথমিকভাবে সাপোর্ট এবং রেজিস্ট্যান্স নির্নয় করে ট্রেডে এন্ট্রি/এক্সিটনেন অথবা ট্রেডের ডিরেকশন নির্নয় করেন।
❇️ নিউজ ভিত্তিক ট্রেডিং (News Dependent Trading)- এইস্ট্র্যাটেজির মূল ভিত্তি হল সমসাময়িক এবং গুরুত্বপূর্ন নিউজ ইভেন্টগুলো যেগুলোর মার্কেটের উপর প্রত্যক্ষও পরোক্ষ প্রভাব ফেলে।
১. ডে-ট্রেডিং শুরু করবার পূর্বে আপনাকে এর মূললক্ষ্য স্থির করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে ডে-ট্রেডিং দ্রুত ধনী হওয়ার কোন পন্থা নয়। অনেকেই মনে করেন ডে-ট্রেডিং খবই সহজ , শুধুমাত্র প্রাইজ কমলে কিনতে হবে এবং প্রাইজ বাড়লে বিক্রয় করতে হবে। কিন্তু এটি এত সহজ নয়, এই সত্যটি মেনে নিয়ে ডে-ট্রেডিং শুরুকরা উচিৎ। এটি যদি এতই সহজ হতো তাহলে সবাই সফল ট্রেডার হতো। এটি বেশ কঠিন তাই এখান থেকে আয় করতে বেশ কিছু দক্ষতার প্রয়োজন হবে। সেই দক্ষতা গুলো অর্জন করতে না পারলে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রফেশনাল ডে-ট্রেডিং এর জন্য প্রয়োজন নিয়মানুবর্তীতা, অধ্যাবসায়,পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ; যার সমন্বয়েই কেবল একজন সফল ডে ট্রেডার তৈরিহতে পারে।
২. ডে-ট্রেডিংএ লাভবান হতে হলে আপনাকে অন্যান্যদের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেই হবেনা, আপনাকে হতে হবে সবচেয়ে চমৎকার কিছু গুনের অধিকারী যাতে করে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল যে ডে-ট্রেডিং প্রায়ই আবেগঘন , আবেগ প্রবন জুয়াড়ি এবং যারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী তাদের কাছে আকর্ষণীয় সুযোগ বলে মনে হয়। ট্রেডিংকে বুদ্ধিমত্তার সাথেসঠিক মূল্যায়ন এর মাধ্যমেই একজন সফল ট্রেডার তৈরি হয়। ইমোশনাল ট্রেডিং হচ্ছে ব্যর্থ ট্রেডার হওয়ার প্রথম কারন, তাই আপনার প্রয়োজন হবে সেলফ ডিসিপ্লিন এবং সুরক্ষিত অর্থব্যবস্থাপনা বা মানি ম্যানেজমেন্ট। আপনাকে নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং আপনার বিভ্রান্ত ধারণা গুলোকে পরিবর্তন করতে হবে।
৩. এক্ষেত্রে আরেকটিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মার্কেটে শেয়ারের প্রাইজ মুভমেন্ট এর কারন সম্পর্কে জানা ওতারপর ট্রেড করা। এ বিষয়ে জানতে হলে আপনাকে কিছু গবেষণা করতে হবে যে শেয়ারের মুভমেন্ট কি একক কোন কারনে হচ্ছে নাকি সম্পূর্ন মার্কেটের মুভ এর সাথে প্রাইজের পরিবর্তন হচ্ছে। এটি জানার উপর আপনার একাউন্ট কখনো কখনও অনেকবড় ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকবে। একজন ডে ট্রেডারকে সেই শেয়ার গুলোকে বাছাই করতে হয় যেগুলোর পর্যাপ্ত মুভমেন্ট হয় কিন্তু কারন না জেনে ট্রেড করলে ভূল হলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশী থাকে। তাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ন নিয়ম হল প্রাইজের মুভমেন্টের কারন অনুসন্ধান করা। এজন্য প্রয়োজনীয় নিউজ সাইট গুলোতে চোখ বুলাতে ভুলবেন না।
৪. একটা কথা সবাইজানি যে, যেখানে রিস্ক বেশি সেখানে রিওয়ার্ডও বেশি। ডে-ট্রেডিং এর সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে সঠিক রিস্ক রিওয়ার্ড রেশিও এর উপরে। শেয়ার মার্কেটে স্টপ লস মেনে নিতেই হবে, এক্ষেত্রে গোয়ার্তুমি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই ডে-ট্রেডিং এর শেয়ার বাছাই এর ক্ষেত্রে অবশ্যই এমন শেয়ার বেছে নিতে হবে নিতে হবে যার রিস্ক রিওয়ার্ড রেশিও বেশি। সফল ট্রেডারগন লস করে না এমন নয় কিন্তু সঠিক রিস্ক-রিওয়ার্ড রেশিওর জন্য তারাদীর্ঘ সময়ের ট্রেডিং এ এগিয়ে থাকে।
ডে-ট্রেডিংএর জন্য কিছু বেসিক টুলস প্রয়োজন যা সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করছি।
Ø ব্যবসায়ীক পরিকল্পনাঃ অন্যান্য ব্যবসায়ের মত ডে-ট্রেডিং এর জন্যও দৃঢ়পরিকল্পনা প্রয়োজন। যার মধ্যে থাকবে আপনার স্ট্র্যাটেজি, আপনার ট্রেডিং সংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য ট্রেডিং ডিভাইস ও অন্যান্য আনুসাংগিক প্রয়োজনীয় টুলস এর জন্য কত টাকা বিনিয়োগক রবেন তাও নির্ধারন করা প্রয়োজন।
Ø এডুকেশনবা শিক্ষাঃ এমন কেউ কি আছেন যিনি এক দুইটা আইনের বই পড়েই ল’চেম্বার খুলেছেন, বা কিছু ইউটিউব ভিডিও দেখেই ডক্টরের চেম্বার খুলে বসেছেন? নিশ্চয়ই নয়। ডে-ট্রেডিং ও এই প্রফেশন গুলো থেকে আলাদা কিছু নয়। ট্রেডিং একটি সর্বদা চ্যালেঞ্জিং প্রফেশন যেখানে প্রতিনিয়ত নতুননতুন অবস্থার উদ্ভব হয় তাই তাই সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে কমপক্ষে তিন মাস ডেমো প্রাকটিস করার পরেই রিয়েল ডে-ট্রেডিং শুরু করা উচিত।
Ø ব্যবসা শুরুর জন্য স্টার্ট-আপক্যাশ ক্যাপিটালঃ অন্যান্য সকল ব্যাবসায়ের মতই ডে-ট্রেডিং এর জন্যও আমাদের শুরুতে কিছু পুজি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। যেমন ভালো কনফিগারেশন সহ একটি কম্পিউটার, একটি স্মার্টফোন বা ট্যাব এবং ট্রেডিং এরজন্য কিছু বিনিয়োগ। অনেক ব্যবসা (ডে-ট্রেডিং ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত), ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ হলো পুজির সংকট এবং সঠিক পুজি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার ফলে। ডে-ট্রেডিং থেকেআয় করতে হলে বেশ কিছুটা সময় প্রয়োজন, এক্ষেত্রে আপনার পর্যাপ্ত পরিমাণ ষ্টার্টআপ ফান্ড থাকতে হবে। যেখানে প্রায়শই নতুন ট্রেডারগন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অবজ্ঞা করেট্রেড শুরু করেন (যেমন সঠিক শিক্ষা সঠিক টুলস এবং প্লাটফর্ম) যাতে করে তাদের প্রাথমিক পূঁজির বিনিয়োগ পরিমাণ কম না হয়। তারা অতি অল্প পরিমাণ পুজির বিনিয়োগে তূলনামূলক ভাবে অনেক বেশী আশা করে বা করতে যায় যা তাদের নিয়ে যায় ট্রেডিং এর সবচেয়ে ক্ষতিকর অবস্থা,ইমোশনাল ট্রেডিং এর দিকে।
Ø সঠিক টুলসঃ টুলসের মধ্যে রয়েছে-হাই স্পীড ইন্টারনেট সংযোগ, সঠিক ব্রোকার, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনলাইন/অফলাইন কমিউনিটির সাথে যুক্ত থাকা ইত্যাদি। এসকল টুলসের জন্য হয়ত আপনাকে মাসিক বা বাৎসরিক কিছু এক্সট্রা খরচ বহন করতে হবে যা আপনি আপনার ব্যবসায়ের প্রতি মাসের খরচ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন।
❇️ আপনি আপনার কাছে থাকা ম্যাচিউর্ড শেয়ার একদিন বা দুই দিনের মধ্যে কেনা বেচা করতে পছন্দ করেন।
❇️ দিনের শুরুতে আপনার মার্কেট অ্যানালাইজ করার জন্যসময় দিতে হবে আর সেটা সম্পূর্ন ট্রেড আওয়ারে মনিটর করতে হবে।
❇️ দিনের শেষে আপনি লাভ না লস করলেন সেটা আপনার জেনে ঘুমাতে যেতে হয়।
ডে-ট্রেডার হবেন না যদিঃ
❇️ আপনি লং অথবা মিডল টার্মের ট্রেডিং পছন্দ করেন।
❇️ আপনার সারাদিনে মার্কেট অ্যানালাইজ এবং মনিটর করার সময় নেই।
❇️ আপনার ডে-জব আছে।
পরিশষে বলতে চাই, যাদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে আগ্রহ আছে বা যারা টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস বা প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ বোঝেন তারা ডে-ট্রেডিং করে কিছু মুনাফার পাশাপাশি নিজের পোর্টপোলিওকে বড় পতন থেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু বাজার সম্পর্কে যাঁদের তেমন ধারনা নেই, তারা ডে-ট্রেডিং করলে আরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তাই ভাল ভাবে বাজার-বিশ্লেষণ শিখে নিয়ে তারপর শুরু করা যেতে পারে ডে-ট্রেডিং।